অপেক্ষা
আমি গাড়িতে বসে আছি। ডানে বামে দেখছি। একটু দূরে একজন নারী বসে আছে। তার কোলে একটা ছোট্ট শিশু। দেখে মনে হচ্ছে নারীটি গরীব ঘরের কেউ হবে। একটা কাগজের ঠোঙ্গা দিয়ে বাচ্চাটাকে বাতাস করছে।
বাচ্চাটা তবুও কাঁদছে। তার বয়স আনুমানিক এক থেকে দেড় বছর হবে, তার কমও হতে পারে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে আছি মনোযোগ দিয়ে। এতটাই মনোযোগ দিয়েছি যে রাস্তার জ্যাম ছুটে গাড়িটি একটু সামনে গেছে কিন্তু আমার মনোযোগ ছুটে না।
এদিকে প্রচণ্ড গরম। আমার শরীর ঘেমে গেছে। বলা যায় শার্ট ভিজে গেছে। এবার আন্দাজ করতে পারেন তাপ কতটা ছিলো। যাই হোক, আমার মনোযোগ ছিলো নারীটির দিকে। সে দেখতে খুবই রোগা ছিলো। তার সন্তানকে সে ঠোঙ্গা দিয়ে বাতাস করলেও সন্তান কাঁদছে। এমনভাবে কাঁদছে যে নারীটিও সহ্য করতে পারছে না।
একটু পর আমি লক্ষ্য করলাম নারীটি তার বাচ্চাকে মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে বাতাস করছে। এবার মনে হচ্ছে বাচ্চা একটু শান্ত হয়েছে।এই বিষয়টি আমার একটু বেশীই ভালো লেগেছে।কিন্তু নারীটিকেও দেখে মনে হচ্ছে গরমে অতিষ্ঠ। তার চোখেমুখে ভেসে উঠছে যন্ত্রণার ছায়া।
আমি তখনও নিশ্চুপ হয়ে দেখছি। মনে মনে ভাবছি কী করতে পারি? এর মধ্যে ভাবছি, আমরাতো হরহামেশা মানবতা, মনুষ্যত্ব নিয়ে আলোচনা করি। বাস্তবে সেটা কতটুকু পালন করি! এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। গাড়ি থেকে নেমে পরলাম, নারীটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মানে টাকা চাইছে।
আমি তখন বললাম, ‘এই নেন ১০০ টাকা। একটা হাতপাখা কিনে বাচ্চাকে বাতাস কইরেন।’ নারীটি অনেক খুশি হয়ে জবাব দিলো, ‘ঠিক আছে বাবা।’
কিন্তু নারীটি হাতপাখা কিনবে না। কারণ সারাদিন ভিক্ষা করে যা টাকা পায় তা দিয়ে তার আর তার বাচ্চার খাবারের খরচ হয় না। হাতপাখা কিনবে কোন সুখে!
এমন চিন্তা আমার ভেতরও চলছে। তখন আমি বাণিজ্যমেলায় যাচ্ছি। যাওয়ার সময় ভাবলাম, নারীটির জন্য একটা হাতপাখা কিনবো। বাসায় যাওয়ার সময় দিয়ে যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ। মেলায় গিয়ে একটা সুন্দর হাতপাখা কিনলাম। দাম কিছুটা বেশি। এটা ছোট করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা যায়। তাই দামও একটু বেশি। অনেক দরদাম করে কিনতে হয়েছে। একটু আনন্দ নিয়েই যাচ্ছিলাম নারীটির কাছে। ভালো কিছু করতে যাচ্ছি বলে একটু আনন্দ হচ্ছে।
কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে দেখি যে স্থানে নারীটিকে ১০০ টাকা দিয়েছিলাম সেখানে সে নেই। পুরো এলাকাতেই খুঁজেছি অনেক। আশেপাশের দোকানগুলোতেও নারীটির সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। কেউ সঠিক কিছু বলতে পারলো না।
রাত যখন ১১টা তখন বাসা থেকে বাবার ফোন আসলো। এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিনি কখনো। তাই বাবা একটু বকাও দিলো।
তাড়াতাড়ি বাসার দিকে রওনা দিলাম। সেই সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নারীটির খোঁজ করেও পেলাম না। মনটা আমার বিষাদে ভরে গেলো। খুব খারাপ লাগছে। বাসায় গিয়েও মাথায় একই বিষয় নিয়ে ভাবছি। বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছে আমি চিন্তিত। তাই তারা খুব গুরুত্ব দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কী হয়েছে। আমি ঘটনার কথা তাদের খুলে বলি।
তাড়াতাড়ি বাসার দিকে রওনা দিলাম। সেই সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নারীটির খোঁজ করেও পেলাম না। মনটা আমার বিষাদে ভরে গেলো। খুব খারাপ লাগছে। বাসায় গিয়েও মাথায় একই বিষয় নিয়ে ভাবছি। বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছে আমি চিন্তিত। তাই তারা খুব গুরুত্ব দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কী হয়েছে। আমি ঘটনার কথা তাদের খুলে বলি।
এরপর আমার বাবা-মা আমাকে সান্ত্বনা দেয়। বাবা বলেন, কপালে ছিলো না তাই তুমি হাতপাখাটি দিতে পারোনি।এটা নিয়ে চিন্তা করলে কোনো লাভ হবে না। তবুও চিন্তাটা মাথায় থেকে গেলো। হাতপাখাটিও আমার ব্যাগে থেকে গেলো। আজও আমি নারী ও তার বাচ্চাটাকে খুঁজি, হাতপাখাটি দেবো বলে।
মাহাবুব আলম সায়েম
নবম ব্যাচ
No comments